প্রতিষ্টা ঘোষ, ব্যারাকপুর: ৪০ বছর বয়সে তার সংসদীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তারপর দুই দফায় ১২টা বছর রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে কাটিয়ে দিয়েছেন। প্রথমবার জনতা দলের হয়ে গুজরাতের রাজ্যসভা সদস্য হিসাবে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ এবং দ্বিতীয়বার ২০০২ থেকে ২০০৮ তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে পশ্চিমবাংলার রাজ্যসভা সদস্য হিসাবে। ২০০৯ সালে অবতীর্ন হন লোকসভা নির্বাচনে, তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে। জিতেও যান, শিকে ছেঁড়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার। এমনকি হয়েছিলেন রেলমন্ত্রীও। কিন্তু সেই রেলমন্ত্রী পদে থাকাকালীন সময়েই রেলের ভাড়াবৃদ্ধি নিয়ে দলের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ফলস্বরূপ রেলমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। দলের সঙ্গেও সাময়িক ভাবে তৈরি হয়েছিল দূরত্ব। তারপরেও দিদিমণি আস্থা রেখেছেন ২০১৪ সালেও। ফের তাকে দিয়েছিলেন ভোটে লড়াই করার টিকিট। কারণ মানুষটার নাম যে দীনেশ ত্রিবেদী। দুর্নীতির কোন অভিযোগ যাকে এখনও স্পর্শ করে উঠতে পারেনি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে যার কিছুটা হলেও পরিচিতি আছে। এবারেও দিদিমণি ভরসা রেখেছেন তার ওপর। দিয়েছেন ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে লড়াই করার ছাড়পত্র। কিন্তু এবার দীনেশের গলায় একটা কাঁটাও বিঁধেছে, যার নাম অর্জুন সিং।
ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল এলাকাই হোক কি লোকসভা কেন্দ্র, ভাটপাড়া পুরসভা এলাকা দুইয়ের মধ্যেই পড়ে। আর সেই বাম জমানা থেকেই ভাটপাড়ায় কার্যত শেষ কথা বলে এসেছেন অর্জুন সিং। বাবা সত্যনারায়ণ সিং ছিলেন ভাটপাড়ার কংগ্রেস বিধায়ক। তাই রাজনীতির হাতেখড়িটা তার বাড়িতেই হয়ে গিয়েছিল। কলেজে পড়তে পড়তেই জড়িয়ে গিয়েছেন সক্রীয় রাজনীতিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল গঠনের ঘটনা বদলে দিয়েছিল অর্জুনের রাজনৈতিক জীবন। তিনিও কংগ্রেস ছেড়ে পা বাড়িয়েছিলেন তৃণমূলের পথে। ক্ষমতার লোভ তাকে কোনকালেই স্পর্শ করেনি। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই ভাটপাড়া পুরসভা এলাকা তো বটেই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলেও দলের সংগঠন দেখে গিয়েছেন অর্জুন। দলের প্রার্থী হিসাবে লড়েছেন বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনও। ২০০১ সাল থেকেই অর্জুন টানা ভাটপাড়ার বিধায়ক। ১৯৯৯ আর ২০০৪ সালে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের হয়ে লড়াইও করেছেন। হেরে গেলেও তৎকালীন বাম সাংসদ তড়িৎবরণ তোপাদারের বিরুদ্ধে লড়াই করার যে সাহস অর্জুন দেখিয়েছিলেন তা চমকে দিয়েছিল সবাইকে। ২০০৫ সাল থেকে ভাটপাড়া পুরসভার চেয়ারম্যান অর্জুন সিং। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচণে ব্যারাকপুরে দীনেশ ত্রিবেদীর প্রার্থী হওয়া পছন্দ হয়নি অর্জুনের। কিন্তু দলনেত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন কথাও বলেননি। রেলমন্ত্রী পদে থাকাকালীন দীনেশের দলবিরোধী পদক্ষেপ দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন এবার বোধহয় শিকে ছিঁড়বে অর্জুনের কপালে। কিন্তু তাও হয়নি। ২০১৪সালে দীনেশেই আস্থা রেখেছিলেন বাংলার অগ্নিকন্যা।
২০১৬সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে হারাতে হাতে হাত মিলিয়ে জোট বেঁধেছিল বাম আর কংগ্রেস। সেই সময় দীনেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি দিল্লিতে সংসদের অধিবেশন চলাকালীন সময়ে নানা দলের সাংসদের ডেকে ডেকে জানিয়েছিলেন, তৃণমূল নাকি আর ক্ষমতায় ফিরবে না। দীনেশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ গিয়েছিল মমতার কানেও। সেই ঘটনা এখনও অনেকটাই তরতাজা। শোনা গিয়েছে, দীনেশের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই এবার অর্জুন নিজেই দলনেত্রীর কাছে ব্যারাকপুর লোকসভা আসনে লড়াই করার আর্জি জানিয়েছিলেন। যদিও সেই আর্জি যে পূরণ হয়নি সেটা মঙ্গলবার তৃণমূলের ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়। এবারেও ব্যারাকপুরে তৃণমূলের প্রার্থী দীনেশই। কিন্তু অর্জুন কি করবেন? গত এক-দুই সপ্তাহ ধরেই জোর জল্পনা চলছে তৃণমূল থেকে এবারে ব্যারাকপুরের টিকিট না পেলে অর্জুন বিজেপির টিকিটে লড়াই করতে পারেন ব্যারাকপুর থেকে। সেই জল্পনায় জল ঢালেননি অর্জুন। বরঞ্চ দিয়েছেন বেশ কিছু ইঙ্গিতপূর্ন তথ্য। মঙ্গলবারই তিনি জানিয়েছেন, ‘দীনেশ ত্রিবেদী ব্যারাকপুর চিনতেন না। আমিই তাকে হাত ধরে এলাকা চিনিয়েছি। দলে যতদিন থাকব ততদিন প্রচার তো করতেই হবে।’
আর এখানেই দেখা দিয়েছে প্রশ্ন! অর্জুন কি ভেতর ভেতর বিজেপির সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন? খুব শীঘ্রই দল বদল করছেন? এদিনও অবশ্য অর্জুন জানিয়েছেন তিনি তৃণমূলেই থাকছেন। তার বিজেপিতে যোগদানের তথ্য ভুল। ইচ্ছাকৃত ভাবে তা কিছু মিডিয়া মারফত প্রচার করা হচ্ছে। যদিও বিজেপির নেতারা এখনও আশাবাদী অর্জুন আসবেন গেরুয়া শিবিরেই। প্রার্থীও হবেন তাদের হয়েই। আর যদি তা হয় তাহলে তৃণমূলকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যেতে হবে। কারণ একে তো অর্জুন অবাঙালি, ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রটিতেও প্রচুর অবাঙালি ভোটার রয়েছেন। দুইয়ের মিলনে গেরুয়া শিবির ভাল ভোটই পেয়ে যাবে। তারওপর অর্জুনের দলত্যাগ ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বেকায়দায় ফেলবে রাজ্যের শাসক দলকেও। যদিও এই সব হিসাবনিকেষে পড়ে থাকছেন না দীনেশ। দেশের সেরা সাংসদ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর দিদির বরাভয় তাকে ফের লড়াইয়ের ময়দানে নামিয়ে দিয়েছে। মঙ্গলবার প্রার্থী হিসাবে তার নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দীনেশ ত্রিবেদীর সমর্থনে ব্যারাকপুরে প্রচার শুরু করে দিয়েছে দলের কর্মীরা। শুরু হয়ে গেছে দেওয়াল লিখনও। শুধু বার বার দীনেশের গলায় বিঁধছে অর্জুন নামের কাঁটা।