রাজেশ সাহা, কলকাতা: করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গোটা দেশজুড়ে যে কোনও রকম জমায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। মহামারী এই ভাইরাস থেকে রাজ্যবাসীকে দূরে রাখতে প্রায় প্রত্যেক দিন নিয়ম করে পাখি পড়ানোর মতো বুঝিয়ে চলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কটা দিন রাজনীতি, ধর্ম সব কিছু দূরে রেখে মানুষকে সচেতন হতে নাগারে অনুরোধ করে চলেছেন তিনি। তারপরেও কেন্দ্র ও রাজ্যের এই নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কোথাও কোথাও দিব্যি চলছে জমায়েত। নবান্ন সূত্রে খবর, জেলাস্তরে বেশ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের উদ্যোগে জমায়েত হয়েছিল বলে খবর গিয়েছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কানে। তাতে বেশ অসন্তোষ উগরে দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কটা দিন সমস্ত সংগঠনকে জমায়েত না করতে ফের একবার বার্তা দিয়েছেন তিনি।
একইসঙ্গে এনআরসি এবং সিএএ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে এখনও পর্যন্ত পার্ক সার্কাস ময়দানে একইভাবে জারি রয়েছে প্রতিবাদীদের জমায়েত। যেখানে সতর্কতা অবলম্বনের বিন্দুমাত্র বালাই নেই। আন্দোলনকারীদের কারোর মুখে নেই মাস্ক, ব্যাবহার করা হচ্ছে না হ্যান্ড স্যানিটাইজার। কোনও রকম নিয়ম না মেনেই চলছে প্রতিবাদ আন্দোলন। যা এই মুহুর্তে কতটা যুক্তি সঙ্গত, সেই প্রশ্ন তুলছেন চিকিৎসক মহলের একাংশ।
শনিবার ৭৫ দিনে পদার্পণ করল পাক সার্কাস ময়দানের এই আন্দোলন। মোদি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আইনে পাস করাতেই, দিল্লির শাহীনবাগের ধাঁচে নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে। ধীরে ধীরে এক টুকরো শাহীনবাগই যেন উঠে আসে পার্ক সার্কাসে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের উদ্যোগেই শুরু হয় এই প্রতিবাদ। দেশ বাঁচাতে নিজেদের বাড়ি ঘর ফেলে এসে কোলে শিশু নিয়েই দিন রাত ধর্নায় সামিল হন শয়ে শয়ে মানুষ। ক্রমেই এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ায় সমাজের একটা বড় অংশ। নাগরিকত্ব আইনের ইস্যুকে হাতিয়ার করে সার্বিকভাবে সব স্তরের সমর্থন পেতে থাকে কলকাতার এই ছোট্ট শাহীনবাগ। পুলিশি নিরাপত্তার ঘেরাটোপেই চলতে থাকে লাগাতার ধর্না।
কিন্তু প্রশ্ন হল, বর্তমানে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের জমায়েত সুস্থ সমাজের পক্ষে ঠিক কতটা নিরাপদ? প্রশ্নটা তুলছেন চিকিৎসকদের একাংশই। বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের এই আক্রমণকে যখন মহামারি আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইতিমধ্যেই এই ভাইরাস থাবা বসিয়েছে ভারতেও। নতুন করে এই ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে তাই যেকোনো রকম জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিন্দুমাত্র বিরোধিতায় না গিয়ে সুস্থ সমাজের পক্ষে সওয়াল করে, কেন্দ্রের এই নির্দেশিকা মেনে চলছে খোদ নবান্নও। কিছুদিন আগেই এই নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “আমি কিন্তু কেন্দ্রের সঙ্গে খুব ঝগড়া করি, অথচ এই বিষয় নিয়ে কোন রকম বিরোধিতায় যাচ্ছি না। কারণ এটা রাজনীতির সময় নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়। মানুষকে আগে বাঁচতে হবে, সমাজ বাঁচলে তারপর সব”।
মুখ্যমন্ত্রী নিজেও দিন রাত জেগে রাজ্যকে করোনা ভাইরাস থেকে দূরে রাখতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বারবার বলছেন, দল বা ধর্ম না দেখে সমস্ত রকম জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে। চিকিৎসকরা বলছেন, “এই মুহূর্তে সরকারের নির্দেশ মেনে খুব প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় না বেরিয়ে, নিজেদের গৃহবন্দী করে রাখাটা ভীষণ জরুরী। তাতে শুধু নিজের নয় গোটা সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব এই ভাইরাসের হাত থেকে”। সরকারের এই নির্দেশিকা না মানলে কঠোর পুলিশি পদক্ষেপ করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তারপরও প্রশ্ন উঠছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কেন্দ্র ও রাজ্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যখন লড়াই করছে, তখন এই সময় ময়দানে জমায়েত হয়ে সংঘটিত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কতটা সঙ্গত?
শুক্রবার পার্ক সার্কাস ময়দানের আন্দোলন স্থলে পৌঁছে দেখা গেল, আগের তুলনায় কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে লোকবলে। তবে আন্দোলন এখনো একই গতিতে চলছে। মাইক হাতে উচ্চস্বরে কেন্দ্র বিরোধী স্লোগান দিয়ে চলেছে দুই কিশোর। তাদের ঘিরে রেখেছেন প্রায় জনা পঁচিশেক মহিলা আন্দোলনকারী এবং সর্বস্তরে রয়েছেন পুরুষরা। সব মিলিয়ে শুক্রবার দুপুরেও পার্ক সার্কাস ময়দানে ভিড় ছিল অন্তত জনা পঞ্চাশেক প্রতিবাদীর। উল্লেখযোগ্যভাবে, একজনেরও মুখে নেই মাস্ক। ধর্না মঞ্চে ব্যবহার করা হচ্ছেনা হ্যান্ড স্যানিটাইজার। যা সরকারি নির্দেশিকাকে একপ্রকার বুড়ো আঙ্গুল দেখানো ছাড়া কার্যত আর কিছু না। করোনার সংক্রমণ সময়ে পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে কি ভাবছেন আন্দোলনকারীরা? মঞ্চে উপস্থিত এক মহিলা আন্দোলনকারী জানান, “সরকারের এই নির্দেশিকার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশ আমাদের কাছে নেই”। আর তাছাড়া সরকারের নির্দেশ মেনে নিজেদের গৃহবন্দি রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব বলেও জানান তিনি। উল্টে সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেন তিনি।
ওই আন্দোলনকারীর প্রশ্ন, “এত ভাইরাস কোথা থেকে আসছে? বিদেশ থেকে আসা ভাইরাসকে ঠেকাতে কেন পারছে না আমাদের সরকার”? তিনি আরো বলেন, “রাস্তায় বেরোনো কজনের মুখে মাস্ক আছে বলুন তো? কিন্তু মঞ্চে আন্দোলনরত মহিলাদের কারোর মুখে মাস্ক নেই কেন? কেনই বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যাবহার করা হচ্ছে না? সরাসরি উত্তর এড়িয়ে তিনি বলেন, “এখানে কারোও সর্দি-কাশির উপসর্গ দেখলেই তাকে রুমাল ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছি, আর স্যানিটাইজার ব্যবহার করার কথা ভাবা হয়েছে”। কিন্তু একবার ক্ষতি হয়ে গেলে তার মাসুল কি গোটা রাজ্যকে দিতে হবে না? এই প্রশ্নে কার্যত নিরব সকলেই।