সিরাজুল ইসলাম
১৯৪২ সাল। জার্মানি থেকে জাপান যাত্রা। দীর্ঘ ৯০ দিনের এই সাবমেরিন যাত্রায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একমাত্র সঙ্গী ছিলেন আবিদ হাসান। বিশ্বস্ত সেই সঙ্গী আবিদ হাসানকে নেতাজি একবার বলেছিলেন, ‘আবিদ ধর্ম আর রাজনীতি কখনও একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলবে না। প্রত্যেকে তার নিজের ধর্ম যেমন ইচ্ছা পালন করবেন। মনে রাখবে, সবার ওপরে আমরা ভারতীয়। আমরা ভারতের জন্য সংগ্রাম করছি।‘
ধর্ম আর রাজনীতি নিয়ে এই ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দর্শন। বরেণ্য এই বাঙালি দেশনায়কের জন্মদিন পালন ঘিরে এবছর এক অন্যরকম উন্মাদনা দেখা গেল এই বঙ্গে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পথে নেমে পড়লেন রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু, রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুর যে দর্শন, আজকের রাজনীতিবিদদের কাছে সেই দর্শন যেন একেবারে কোনও অন্য গ্রহের বস্তু। আজ রাজনীতি আর ধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাতে টাল খাচ্ছে ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুমহান ঐতিহ্য। মেকি দেশপ্রেমের জিগির তোলা নেতাদের কাছে নেতাজির সেই রাজনৈতিক দর্শন আজ একেবারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। তাই বলাই যায়, যতই ঘটা করে তাঁর জন্মদিবস পালন করা হোক না কেন, তাতে নেতাজিকে প্রকৃত অর্থে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে না।
বঙ্গে ভোটের আবহে হঠাৎ করে বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে যাওয়া নেতাজির জন্মদিবস ঘিরে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। সাধারণ কোনও অনুষ্ঠান ছিল না এটি। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। ছিলেন আরও অনেক বিশিষ্ট মানুষ। নিয়ন্ত্রিত অতিথি সংখ্যার পুরোটাই ছিল আমন্ত্রিত। বক্তব্য রাখার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘোষক পোডিয়ামে ডাকার সময় ঘটে সেই অপ্রীতিকর ঘটনা। সকলকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ হাইপ্রোফাইল এই অনুষ্ঠানের দর্শকাসন থেকে উঠতে থাকে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান। ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধীর পায়ে পোডিয়ামে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটি কথা বলে নিজের প্রতিবাদ জানান। বলেন, ‘আমার মনে হয় সরকারি অনুষ্ঠানের একটা শালীনতা থাকা দরকার। এটা কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি নয়। এটা জনতার কর্মসূচি। কাউকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বেইজ্জত করা শোভনীয় নয়।’ প্রতিবাদে কোনও বক্তব্য না রেখে ‘জয় হিন্দ’ ও ‘জয় বাংলা’ বলে নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই ঘটনায় গোটা অনুষ্ঠানের তাল কেটে যায়। বরেণ্য দেশনায়কের শ্রদ্ধা জানানোর সেই অনুষ্ঠানে অবাঞ্ছিত এই ঘটনা যে একেবারে অভিপ্রেত নয়, তা স্বীকার করেছেন বিজেপি নেতাদের একাংশ। ওই ঘটনায় আবার কোনও অন্যায় দেখছেন না কিছু বিজেপি নেতা। বাম-কংগ্রেস নেতাদের তরফ থেকেও এর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
কয়েকদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলের টক শো-তে এসে অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ বলেছিলেন, ‘জয় শ্রীরাম স্লোগানটি যুদ্ধধ্বনির মতো করে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা একেবারেই অভিপ্রেত নয়।‘ তারপর থেকে কম আক্রমণের শিকার হতে হয়নি সায়নীকে। এদিন আবার এই ঘটনা।
‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। বছর দু’য়েক আগে ভাটপাড়ায় মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে মুহুর্মুহু দেওয়া হয় এই স্লোগান। বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে ‘তেড়ে’ গিয়ে প্রতিবাদ করেন। বস্তুত, তার পর থেকে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানটি কোথাও কোথাও কাউকে কাউকে উত্ত্যক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। সাম্প্রতিককালে মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে সেই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া হয় কোচবিহারে। মুখ্যমন্ত্রী সেদিন তাতে কোনও কর্ণপাত করেননি। কিন্তু, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের এই ঘটনা অন্য আর পাঁচটা জায়গার থেকে একেবারেই আলাদা। এখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠানের উপলক্ষ্য ছিল বরেণ্য দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে শ্রদ্ধা জানানো। এদিনের অনুষ্ঠানে অন্য সময় ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া হয়নি। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী যখন বক্তব্য রাখছিলেন, তখনও ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীকে বক্তব্য রাখার জন্য ডাকতেই সেই স্লোগান দেওয়া হয়। আবার মুখ্যমন্ত্রী যখন ভিক্টোরিয়া ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনও দেওয়া হয় সেই স্লোগান। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দেখা যাচ্ছে গোটা বিষয়টি পেছনে বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। আর সেই কারণেই তার প্রতিবাদ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘জয় শ্রীরাম’ শব্দটি নিষিদ্ধ নয় বা আপত্তিকরও নয়। এই শব্দের অর্থ ভগবান রামের নামে জয়ধ্বনি দেওয়া। ভগবানকে কে কখন ডাকবেন, কীভাবে ডাকবেন সেটা একান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু, সেই ভগবানকে ডাকার নাম করে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যদি কাউকে উত্ত্যক্ত করা হয়, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। ‘জয় শ্রীরাম’ শব্দে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সেই স্লোগান ব্যবহার করা হলেই সমস্যা।
এদিনের এই সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপলক্ষ্য ছিল নেতাজিকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো। সেখানে কেন এই ধরনের স্লোগান দেওয়া হবে? ভগবান, আল্লার নামে স্লোগান দেওয়ার জায়গা তো অনেক আছে। মন্দির-মসজিদে স্লোগান দেওয়া হয় সব সময়। কেউ তো কোনও আপত্তি করেন না। আপত্তি করার কথাও নয়। কিন্তু, সরকারি মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ওই স্লোগান একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ওই অনুষ্ঠানে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের বিশেষ উদ্দেশ্য তাই কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
সরকারি কোনও অনুষ্ঠানে কোথাও যদি ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেওয়া হয়, তা কখনওই কাম্য নয়। তাই, এদিন বক্তব্য না রেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রতিবাদ করেছেন, তার পূর্ণ সমর্থন করা উচিত সবাইকে। সর্বস্তর থেকে প্রতিবাদ করে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত, ভগবান বা আল্লার নাম এত সস্তা নয় যে, সেই নাম দিয়ে কাউকে ‘উত্ত্যক্ত’ করা বা ‘ভয়’ দেখানো যায়।