ইস্ক্রা রায়: সব গল্পের একটা ইতিহাস থাকে আর ইতিহাসেরও একটা গল্প থাকে। ইতিহাসের সেই সব গল্প আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে মিউজিয়ামে। আমরা যেমন মিউজিয়ামে গিয়ে অসংখ্য অবাক করার জিনিস দেখি, তেমনই সেই সব জিনিসের ভেতরে যে গল্প আর ইতিহাস লুকিয়ে থাকে সেই সব কিছু নিয়ে তৈরি হয় আরও এক গল্প।
আমাদের হায়াদরাবাদ সফরের গল্প প্রায় শেষের মুখে। সেই গল্পে এর আগে নিজামের এক মিউজিয়ামের গল্প শুনিয়েছি। আজ শোনাব একদা হায়দরাবাদের প্রধানমন্ত্রী সালার জংয়ের গল্প। হ্যাঁ, ঠিক ভেবেছেন, আজকের গল্পে সালার জং মিউজিয়াম। আধুনিক তেলেঙ্গানার রাজধানীর জনপ্রিয় এই ট্যুরিস্ট স্পটে ভিড় যে মন্দ হয় না, তা বলাই বাহুল্য। বিশাল প্রাসাদোপম এই মিউজিয়ামও যে সেই নিজাম রাজত্বের ঠাঁটবাটের ইঙ্গিত দেয়।
তৃতীয় সালার জং নওয়াব মির ইউসুফ আলি খান নিজামের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন বহুকাল। আর তাঁর সখের মধ্যে একটি ছিল দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিল্প সংগ্রহ করা। ১৯৪৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁদের পারিবারিক ডিয়ান ডেভিডে একটি প্রাইভেট মিউজিয়াম হিসাবে তৈরি হয় সালার জং মিউজিয়াম। যা কিনা ১৯৬১ সালে স্বীকৃতি পায় জাতীয় মিউজিয়ামের। আর সেই সময়েই বর্তমান জায়গায় এর স্থানান্তরণ হয়।
এ তো গেল মিউজিয়ামের মিউজিয়াম হয়ে ওঠার গল্প। কিন্তু আর পাঁচটা মিউজিয়ামের থেকে সালার জংয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহের এই মিউজিয়ামকে বাকি মিউজিয়াম থেকে আলাদা করেছে এর বিশেষ কিছু সংগ্রহ।
এখানেই আছে সেই বিখ্যাত ভেইল্ড রেবেকা। পর্দানসিন এক নারীমূর্তি এই ভেইল্ড রেবেকা। এই রকম অবগুণ্ঠিতা রেবেকা মূর্তি নাকি আর একটি আছে সুদূর ইতালিতে। এই ধবধবে সাদা মার্বেল ভাস্কর্যটি ইতালীয় নিওক্লাসিক্যাল ভাস্কর জিওভানি মারিয়া বেনজোনির অসাধারণ সৃষ্টি।
এই ঘরেই আছে ইতালি ও সেই সময়ের পাশ্চত্য শিল্পকর্মের আরও অসাধারণ কিছু নিদর্শন। কিন্তু শুধুই রেবেকা নয়, এখানেই পাবেন দেখতে পাবেন একটি ঘড়ি, যার সঙ্গে আবার অল্প একটু যোগ আছে শহর কলকাতার।
উনবিংশ শতকের শেষে এটি ৩৫০টি পার্টে ইংল্যান্ড থেকে এনে শহর কলকাতায় অ্যাসেম্বল করা হয় ঘড়িটি। আর এই ঘড়ির বৈশিষ্ট্য এখানেই শেষ নয়, প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় এই ঘড়িতে যে ঘণ্টা পড়ে তা শোনার এবং দেখার মতন। ঘড়ির ভেতর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এসে ঘড়ির ঘণ্টা বাজিয়ে সময়ের জানান দেয়। আর তা দর্শকদের দেখার জন্য এই ঘড়ির সামনে ভাল রকমের বসার জায়গা করা আছে।
আর একটি কাঠের শিল্পমূর্তি, যার একদিকে মানুষের ভালর ছবি আবার অন্য দিকে আয়নায় দেখা যায় মানুষের খারাপ দিকের ছবি।
সালার জং গেলে এগুলি দেখা যেমন অতিআবশ্যক, তেমনই এই মিউজিয়ামে অসংখ্য জিনিসের সংগ্রহ দেখার মতন। বিভিন্ন আকার ও শেপের দাবা, হাতির দাঁতের বিভিন্ন সময় আর দেশের বিভিন্ন কাজ। আর এইখানে টিপু সুলতানের ব্যবহৃত হাতির দাঁতের চেয়ার-টেবিলও দেখা যাবে। দেখা যাবে পাল সাম্রাজ্যের বঙ্গভূমির পাথরের মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি সহ একাধিক পুরাতাত্ত্বিক মূর্তি।
আবার তেমনি পাবেন বহু পুরনো পুঁথির সংগ্রহ, আর এর সঙ্গে অয়েল পেন্টিং রুমে পাবেন একাধিক অসাধারণ ছবি যেখানে মোনালিসার রেপ্লিকা ছবি দেখে কে বলবেন যে, এটি আসল মোনালিসার ছবি নয়!
সালার জং পরিবারের সবার ছবি ও ব্যবহৃত জিনিসও এই মিউজিয়ামের অংশ। বিশাল বড় এই মিউজিয়ামের প্রতি ঘরে কত না জানা জিনিসের সমারোহ, তা না দেখলে বোঝা মুশকিল। আছে একটি আসল রত্নের রুমও। তবে তা বেশিরভাগ সময়ে সিকিউরিটির কারণে বন্ধ থাকে।
আর হ্যাঁ, অবশ্যই মিউজিয়ামের বাইরে আছে তৃতীয় সালার জংয়ের একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি।
তাই ইতিহাসের অসংখ্য গল্পের গল্প হওয়ার গল্প যদি শুনতে চান, তবে অবশ্যই হায়াদরাবাদ সফরে এই সালার জং মিউজিয়ামে আসা উচিত।