শ্যামলেশ ঘোষ: দেশের ১২ শতাংশ নাগরিকই কানে ভাল করে শুনতে পান না। গাড়ির কানফাটানো হর্নের দাপটে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাও পরিসংখ্যানটি দু’বছর আগের। মাত্র সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে এখনই যদি এই অবস্থা হয়, আগামী দিনে তা হয়ে উঠবে আরও মারাত্মক। তাই সোশ্যাল সাইটে বাতেলা না মেরে সোজা রাস্তায় নেমেছেন বাংলাদেশের এক তরুণ। নাম তাঁর মোমিনুর রহমান রয়েল। শব্দদানবের বিরুদ্ধে তাঁর এই নীরব প্রতিবাদ খবরের শিরোনামে এসেছে।
রাজধানী ঢাকা শহরের ব্যস্ততম রাজপথে একাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাঁকে। হাতে হলুদ রঙের পোস্টার। তাতে কালো অক্ষরে বাংলা হরফে লেখা, ‘হর্ন হুদাই, বাজায় ভুদাই’। মানে, শুধুমাত্র বোধশূন্য মানুষেরাই খামোকা হর্ন বাজিয়ে চলে। সেই প্রতিবাদী ভাষ্য আগেও সেদেশের শব্দদূষণ-বিরোধী আন্দোলনে দেখা গিয়েছে। স্লোগান হয়ে ওঠা ছড়ার মতো সেই তীব্র বিদ্রূপকেই হাতিয়ার করেছেন ৩৬ বছরের মোমিনুর। একসন্তানের জনকের আশা, সেই পোস্টার দেখে যদি বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ শহরের মানুষের খানিক লজ্জা হয়!
বাংলাদেশের পরিবেশ বিভাগের ২০১৭-র একটি সমীক্ষার রিপোর্ট উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, দেশের অন্তত ১২ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের জেরে শ্রবণশক্তি হারাচ্ছেন। শব্দদূষণে বিশ্বে শীর্ষস্থানে থাকা ঢাকা শহরে দিনের ব্যস্ততম সময়ে শব্দের মাত্রা ১১০ ডেসিবেলে পৌঁছে যাচ্ছে। যা যে কোনও রক কনসার্টকেও হারা মানাবে। ‘শব্দদৈত্যের বিরুদ্ধে এটা আমার নিঃশব্দ প্রতিবাদ। আমি নাগরিকদের কাছে কেবল শব্দ-সচেতনতার বার্তাই পৌঁছে দিতে চাইছি গত কয়েকবছর ধরে। তাতে যদি খানিক টনক নড়ে সকলের।’
পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার মোমিনুর এই প্রচার চালাচ্ছেন চারবছর ধরে। বহু মানুষের সমর্থনও পেয়েছেন তিনি। ‘ঘরে ফেরার পথে অনেকে এসে দাঁড়ান আমার পাশে। অনেকেই প্ল্যাকার্ড ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যান। এদের মধ্যে বেশিরভাগই আমার অপরিচিত। এটা একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষণ বলেই মনে হয়।’ বলেছেন মোমিনুর। অনেকেই তাঁর ছবি তুলে সোশ্যাল সাইটে শেয়ার করে থাকেন। দেশের সরকার হর্ন-বিরোধী আইন পাস করেছে এবং আইনভঙ্গকারীদের ছ’মাসের কারাদণ্ডের সংস্থানও রেখেছে। তা সত্ত্বেও শব্দাসুরবধে ডাহা ফেল ট্রাফিক পুলিশ। কেন?
কারণ, শুধু ঢাকা শহরেই বসবাস ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের। কমপক্ষে দশ লক্ষ রেজিস্টার্ড যানবাহন রয়েছে। এবং দিনকে দিন গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে বেলাগাম হর্নে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের (হু) মতে, মানুষ সর্বাধিক টানা আটঘণ্টা ৮৫ ডেসিবেল পর্যন্ত আওয়াজ সহ্য করতে পারে। সেই মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে বাধ্য। শহরে গাড়ির বেপরোয়া হর্নের পাশাপাশি রয়েছে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত মাইকের বিকট আওয়াজ এবং নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রের জোরালো শব্দও।
পুলিশের মুখপাত্র সোহেল রানা জানাচ্ছেন, প্রায় প্রতিসপ্তাহে শ্রবণ-সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসা ট্র্যাফিকের (পুলিশ) সংখ্যা আমাদের কাছে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোমিনুর মাঝেমধ্যে চিন্তিত হন, কাজের শেষে শহরের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তিনিও কোনও দিন শ্রবণেন্দ্রিয়ের সমস্যায় ভুগতে পারেন। তবে তিনি মনে করেন, ‘বড় কাজের জন্য ছোট ছোট ত্যাগ’ আমাদের করতেই হবে। তাই নিজের শ্রবণশক্তি হারানোর চিন্তাকে হেলায় উড়িয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর মোমিনুরের জেদ, ‘শব্দদূষণ হ্রাস না হওয়া পর্যন্ত পথে আছেন তিনি।’